বুধবার, ২৫ জুলাই, ২০১৮

আকবর, জুনাইদ, আখলাকদের বাড়ী ফেরা হয় না..
_______________________________________________

আকবর খান, পেশায় দুধ ব্যবসায়ী। দুধ বিক্রি করে ষাট হাজার টাকা জমিয়ে হাটে গেছিলেন আরো দুটো বকনা কিনতে। আরেকটু স্বাচ্ছল্য আসবে সংসারে, বউকে কাঁকন গড়ে দেবেন। কিন্তু সংখ্যাগুরুর দেশে সংখ্যালঘুদের স্বপ্ন দেখা যে চুড়ান্ত পাপ একথা জানতেন না আকবর। তাকে পিটিয়ে পিটিয়ে মারা হচ্ছিল। মানুষ জড়ো হয়ে দেখছিল গোরক্ষক বাহিনীর সে উন্মত্ততা। বাঁচাতে আসেনি কেউ। রাষ্ট্রযন্ত্র নির্বিকার ভাবে দেখছিল সব। গোঙাচ্ছিলেন আকবর, বাঁচার আর্তি জানাচ্ছিলেন। রাষ্ট্রযন্ত্র ডান্ডাপেটা করে চুপ করিয়ে বুঝিয়েছে সংখ্যালঘুদের চিৎকার করতে নেই। যুগে যুগে, দেশে দেশে, সংখ্যাঘুদের আর্তি এভাবেই ডান্ডা মেরে চুপ করায় রাষ্ট্রযন্ত্র। সংখ্যালঘুর রক্তে যাতে তাদের সরকারী গাড়ি নোংরা না হয়ে যায়, তারজন্যে গাড়িতে তোলার আগে ভালোভাবে ধোয়া হয় আকবরকে। রাষ্ট্রের পেয়াদারা চা খায়, অপেক্ষা করে, সময় কাটায়। ওদিকে গাড়িতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে একজন মানুষ, যাকে কিনা রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুর দেশ, ঠিক 'মানুষ' বলে মনে করে না। সবমিলিয়ে তিনঘন্টা সময় কাটিয়ে যখন রাষ্ট্রের পুলিশ পেয়াদারা হাসপাতালে পৌছোয়, ততক্ষণে আকবর মৃত। না আকবর নন শুধু, ততক্ষণে সংবিধান মৃত, দেশ মৃত, সভ্যতা মৃত।

ঠিক একইভাবে জুনেদ, ওমর, আখলাক, পেহলু খান, আফরাজুল সহ সরকারী হিসেবে মোট  ৪৬ জন সংখ্যালঘু (না সংখ্যালঘু নয় আপনাদের ভাষায় যারা কৃমি কীট, যারা মানুষের মতো দেখতে হলেও ঠিক মানুষ নয়) গোরক্ষক বাহিনী, এন্টি রোমিও স্কোয়াডের হাতে নির্মম ভাবে খুন হয়েছেন ২০১৭ সাল থেকে এখন অব্দি। মারধরের পরিসংখ্যানটা আর নাইবা দিলাম!!

আমাদের মতো কিছু দেশদ্রোহী এতে সরকার আর রাষ্ট্রের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললে, তার জবাব ও বিজেপির বিধায়ক রাজা সিং দিয়েছেন।নিজের গোশালায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, "গরু বাঁচাতে গিয়ে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে গেলে মিডিয়া এমন ভাব করে যেন ভূমিকম্প হয়ে গেছে।" সংঘ নেতা ইন্দ্রেশ কুমার বলেছেন, "গোমাংস খাওয়া ছেড়ে দিন, তাহলেই গণপিটুনি বন্ধ হয়ে যাবে"। সঙ্গে হিতোপদেশ দিয়ে এটাও বলেন, " অবশ্যই গোরক্ষা করা এবং গোবরকে সিমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। তাহলেই অভাব আর গণপিটুনিতে পুর্ণচ্ছেদ পড়বে"।

এসব কথা শুনে আশ্চর্য্য হইনা এখন আর। কারন আমরা দেখেছি এর আগে আফরাজুলের খুনীকে দেবতা জ্ঞানে রথে বসিয়ে রথ টানতে, আমরা দেখেছি সেই খুনীর ব্যাঙ্ক একাউন্টে আমাদেরই সহনাগরিকদের কাড়ি কাড়ি টাকা পাঠাতে। আমরা দেখেছি আলিমউদ্দিনকে যারা পিটিয়ে মেরেছিল তাদের ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করছেন এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। আমরা দেখেছি আখলাকের খুনীদের সম্মান জানাতে সরকারী চাকরিতে নিযুক্ত করা হয়েছে তাদের। আমরা দেখেছি অনেক কিছুই। এখনো দেখে যাচ্ছি। হয়তো নৃশংস খুন হওয়ার আগে অব্দি দেখেই যাবো।

গত তেইশ জুলাই আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত  এক সভায় ছাত্রছাত্রী সহ উপাচার্য্য এবং শিক্ষকদের নৈতিকতার পাঠ দিয়ে গেছেন সুনীল দেওধর। তিনি কে? তিনি আর এস এসের দাপুটে প্রচারক এবং বিজেপির ত্রিপুরা জয়ের অন্যতম কারিগর। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সহ ছাত্রছাত্রীদের সমস্বরে "ভারত মাতাকি জয়" এবং "বন্দে মাতরম" ধ্বনি উচ্চারন করিয়ে তার আঠান্ন মিনিটের ভাষনে  বলেছেন, " দেশমাতার নামে জয়ধ্বনি দিতে কোনো পন্থা অবলম্বনের প্রয়োজন নেই। চিন বা আমেরিকার অনুমতি নেওয়ারও প্রয়োজন নেই। স্বগর্বে দেশমাতাকে শ্রদ্ধা করলে বাড়বে নৈতিক মূল্যবোধ। বাড়বে প্রকৃত মানুষ হওয়ার তাড়না"।

অথচ আমরা দেখেছি জুনেদ থেকে আফরাজুল, আকবর থেকে আখলাক - প্রত্যেককেই "ভারত মাতা কি জয়" "জয় শ্রী রাম" এই স্লোগানগুলো  উচ্চারন করেই নৃশংস ভাবে খুন করা হয়েছে। আমরা দেখেছি নিউজ চ্যানেল এবং ফেইসবুকেই বিভিন্ন ভিডিওতে, সংখ্যালঘু মানুষকে একদল উন্মত্ত ছেলে "ভারত মাতা কি জয়" বলানোর জন্যে বেঁধে রেখে মারধর করছে! ভিখিরি বয়স্ক দম্পতিকেও রেহাই দেয় নি তারা। আমরা দেখেছি রামনবমীর অস্ত্র মিছিলে "ভারত মাতা কি জয়" স্লোগানের তান্ডব। তাহলে "ভারতমাতার জয়" স্লোগানে এই নৃশংস নৈতিকতার পাঠ ই কি দিয়ে গেলেন সুনীল দেওধর? তিনি কি ছাত্রছাত্রীগুলোকে শিখিয়ে গেলেন এইভাবেই স্বগর্বে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে দেশ থেকে বিধর্মী মেরে, তাড়িয়ে স্বপ্নের "হিন্দুরাষ্ট্র" তৈরী কর?? প্রকৃত মানুষ কি তবেই হবে তারা? প্রশ্ন জাগে। আতংকিত হই মানুষ গড়ার কারখানাগুলোতেও এদের থাবা বসানো দেখে!

 সারা দেশ জুড়ে এক শ্রেণির বিকৃত উন্মাদ, মানুষ নামধারী কিছু জানোয়ার, মানুষ নিধন যজ্ঞে মেতেছে বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন চেহারায়। কোথাও গোরক্ষার নামে, কোথাও হিন্দুত্ব রক্ষার নামে। শুধুমাত্র মুসলিম হলেই পিটিয়ে মারা যায়? দলিত হলেই পিটিয়ে মারা যায়? মুসলিম, দলিত, আদিবাসীরা ভারতবর্ষ নামক রাষ্ট্রটির  নাগরিক নন? তাদের সুরক্ষা দেওয়ার দায় নেই রাষ্ট্রের? সরকারের কোনো দায় নেই?? দিনের পর দিন নিরীহ মানুষ গোরক্ষার নামে খুন হচ্ছে আর এইসময়েই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী 200 গরু নিয়ে সদলবলে চলেছেন রোয়ান্ডা। কি বার্তা দিতে চাইছেন তিনি দেশের জনগণকে?? তার মন্ত্রীরা কি বার্তা দিচ্ছে?? তাদের এই বার্তাগুলোই কি জাতি-হত্যাকে প্রশ্রয় জোগাচ্ছে না দিনের পর দিন?? গরু রক্ষার নামে রাষ্ট্রের নাগরিকদের খুন হতে হবে, এটা কোন ধরণের ধর্ম রক্ষা?? কোন ধরনের গণতন্ত্র??

যারা গরুকে দেবতুল্য সম্মান দেয়, তাদের ধর্মীয় অনুভুতির প্রতি যেরকম সম্মান প্রদর্শন করা উচিত, ঠিক সেইভাবে অন্য ধর্মের মানুষ, যারা গরুকে দেবতা মনে করেন না, তাদের প্রতিও সম্মান প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে সংবিধানে। তাহলে কোন ভিত্তিতে দেশের সাধারণ নিরীহ নাগরিকদের একের পর এক খুন হতে হচ্ছে??

এই প্রশ্নগুলোই  আমাদের বারবার করে যেতে হবে। প্রতিটা অত্যাচারের, প্রতিটা নৃশংসতার  ছবি যারা রক্ত দিয়ে এঁকে গেছে, জানিয়ে গেছে, সেটা আরো আরো আরো ছড়িয়ে দিতে হবে। চুড়ান্ত চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যেতে হবে  সরকারের প্রত্যেকটা মানুষহত্যাকারী নীতিকে। এই হত্যালীলাকে কিছুতেই "ট্রেন্ড" হয়ে উঠতে দেওয়া যায় না। কিছুতেই না।


#Not_In_My_Name

#Murder_of_Democracy

রবিবার, ৮ জুলাই, ২০১৮

সেই ছোটবেলা থেকে লক্ষ্য করেছি আমাদের দেশ-সমাজ-ব্যবস্থা কেমন যেন ভালো মন্দের একটা মাপকাঠি তৈরী করে দেয়। আমাদের তথাকথিত শিক্ষা ব্যবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলে "ভালো ছাত্র" "খারাপ ছাত্র" গড়ে তোলার প্রক্রিয়া। সেইসব "ভালোছাত্র"দের কাছে প্রত্যাশা থাকে তারা মেধাবী হবে, পড়ুয়া হবে, ভালো রেজাল্ট করবে, ভালো একাডেমিক কেরিয়ার হবে, সবশেষে একটা ভালো ক্যারিয়ারে ঢুকবে। 

মা-বাবা, শিক্ষক, সমাজ, রাষ্ট্র -চাইবে "ভালো ছাত্র"রা সুবোধ হবে, সুশীল হবে। রাজনীতির মতো নোংরা বিষয় তাদের জন্যে নয়। ওসব খারাপ ছাত্রদের জন্য। কোনোক্রমে মাধ্যমিক পাশেদের জন্যে। শিক্ষিত, মেধাবী ছাত্রদের জন্য রাজনীতি করার মতো গর্হিত অপরাধ আর কিচ্ছুটি নেই। খারাপ ছাত্ররা কোনো ইস্যু নিয়ে মিছিল মিটিং করলে তাতে ভালো ছাত্ররা যোগদান করবে না। রীতিমত টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে হয় তাদের। তাও মিছিলের অর্ধেক রাস্তা থেকে তারা লুকিয়ে বাড়ী ফিরে যায়। (নিজের চোখে দেখা)। 

রাষ্ট্র, পরিবার, সমাজকে খুশী রাখতে গেলে ভালো ছাত্রদের বিভিন্ন কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় বসতে হয়। ভালো ভালো চাকরী ধরতে হয়। এবং এই  ক্রনিক সিস্টেমেটিক ডিসঅর্ডারের মধ্যে দিয়ে এই ছেলে মেয়ে গুলো যেহেতু বেড়ে ওঠে, তাই তারাও মনে প্রাণে বিশ্বাস করে বড় হয়, রাজনীতি বড় নোংরা, ওটা ভালোদের জন্যে নয়। খারাপদের জন্য। ফলত আমার বয়েসী কিংবা আমার পরের প্রজন্মের উচ্চশিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের খুব প্রাউডলি বলতে শুনি - রাজনীতিটা বড় নোংরা। ওসবে কোনো ইন্টারেস্ট নেই। ফালতু, বোগাস কনসেপ্ট। তারা কেউ কেউ হয়তো রাজনীতিতে জড়ায়, কিন্তু সেটা অসুস্থ রাজনীতিতে। নেতাদের দালালী করা রাজনীতিতে। উগ্রজাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট রাজনীতিতে। সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিতে। নিজের  মানুষ হিসেবে বেসিক অধিকারগুলো ভুলে থাকার  রাজনীতিতে। মিথ্যের বেসাতি দিয়ে গড়ে তোলা রাজনীতিতে। 

আর এখানেই আসে শিক্ষকের প্রসঙ্গ। একজন শিক্ষক ই হয়তো পারে ছেলে-মেয়েগুলোকে সুস্থ রাজনীতি সম্পর্কে বোঝাতে, জানাতে, উৎসাহিত করতে। কিন্তু এই শিক্ষকরাও তো এই সিস্টেমের প্রোডাক্ট। সুতরাং এইসব উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকরাও রাজনীতি সম্পর্কে উপরিক্ত মতবাদে বিশ্বাসী। 

তাদের সাথে কথায় জড়ালে আমার বারবার মনে হয় পৃথিবীর সবথেকে নিকৃষ্ট অশিক্ষিত হচ্ছে তারাই। তাদের শিক্ষা তাদের বুঝতে দেয় না, একজন মানুষের জীবনের প্রত্যেকটা ছোটোখাটো বিষয়ের সাথে রাজনীতি জড়িত। সকালের চা থেকে শুরু করে রাতের ভাত, অটো ভাড়া থেকে শুরু করে ট্রেন ভাড়া, স্কুলের ফিস থেকে শুরু করে চাকরীর মাইনে, ওষুধের দাম থেকে শুরু করে বাইক কেনার পয়সা, রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া বা না হওয়া থেকে শুরু করে বিদেশে পড়তে যাওয়া - সবকিছু নির্ভর করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর। অথচ এরাই বুক ফুলিয়ে ঘোষনা দেয় রাজনীতি ঘৃণ্য বস্তু। এসবে যেতে নেই। এরা এতটাই মুর্খ, এতটাই বোকা যে, এরা সারাজীবনেও বুঝে উঠতে পারে না, এদের এই রাজনীতি বিমুখতা কিংবা অজ্ঞতা থেকেই জন্ম নেয় দূর্নীতিবাজ দালাল নেতা মন্ত্রী আমলা। এদের এই মুর্খতা থেকেই জন্ম নেয় বেশ্যা, রাষ্ট্রহীন নাগরিক, ডিটেনশন ক্যাম্প, বেকার, উগ্রপন্থী, ডাকাত, ক্রিমিন্যাল, অভাব, অনাহারে মৃত্যু। এরা সারাজীবন ভালো ছাত্র হওয়ার লক্ষ্যে শুধু পড়েই যায়, কিন্তু পড়া শেষে যখন বেকার হাঁটতে হাঁটতে  জুতোর ফিতা ছিঁড়ে তখন বুঝে আসলে খেতে না পেয়ে আত্মহত্যা করা পরিবারটির সাথে তার কোনো তফাৎ নেই, হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া ছেলেটির সাথেও তার কোনো তফাৎ নেই। পৃথিবীতে একটাই রাজনীতি - বেঁচে থাকার এবং মরে যাওয়ার। তখন সে বুঝতে পারে জে এন ইউ নিয়ে সে যে কানাইয়ার গলা কাটতে চেয়েছিলো সে আসলে তার কথাই  বলেছিলো... আরো অনেক ছেলে মেয়েরা - যাদের সে দেশদ্রোহী তকমায় ভূষিত করে ফেবু ফাটায়, তারা আসলে তার কথাই বলছে!!   

এরা রাজনীতিকে ঘৃণা করি বলে নিজেরা প্রাইভেট কোম্পানীতে উদয়অস্ত চাকরের মতো কাজ করে, এবং কর্মচারীদের স্ট্রাইক কিংবা কৃষক বিক্ষোভকে "প্রতিবাদ ফ্যাশন" বলে আখ্যা দেয়। দৈনিক আট ঘন্টা কাজের ইতিহাস তারা ভুলে যায়, এবং শ্রমিক দিবসকে নেহাৎ এক ছুটির দিন ভেবে বউ/স্বামী ছেলে মেয়ে নিয়ে চিড়িয়াখানা দেখে ছুটি কাটায়। অথচ নিজে যখন কোম্পানীর কাছে লাথ খেয়ে বাস্তবে ফিরে আসে তখন সেই গিয়ে ট্রেড ইউনিয়নের খাতায় নাম লেখায়। তখন বুঝতে পারে দিনশেষে সে নিজেও একজন শ্রমিক। তার সাথে মহারাষ্ট্রের "কৃষক লং মার্চে" খালি পায়ে হাঁটা লোকটার আসলে কোনো তফাৎ নেই। দুজনেরই দাবী এক। তখন হয়তো বুঝার চেষ্ঠা করে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার প্রত্যেকজন নাগরিকের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, যাতে রাষ্ট্র ব্যর্থ।  

তারা সারা ফেইসবুক, সারা অফিস, সারা রাস্তা, বাজার হাটে, ক্লাবে শুধু হিন্দু-মুসলমান, লাভজেহাদ, দেশদ্রোহী, কাশ্মীর, উন্নাও করে গলা ফাটায়, নিজের সন্তানকে স্কুলে অন্য ধর্মের ছেলে-মেয়ের টিফিন খেতে মানা করে, সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের গল্পে ভুলে বাজি ফাটায়, নোটবন্দীতে কি কি লাভ হলো তার ফিরিস্তি লিস্টি ধরে শোনায়, অথচ বুঝতে পারে না দিনশেষে একজন গরীব মুসলমান আর একজন গরীব হিন্দুর স্ট্যাটাস আসলে একই। দুজন ই শোষিত। নির্যাতিত। দুজনের ঘরেই বউয়ের অসুখ, সন্তানের বেকারত্ব, মেয়ের বিয়ের বোঝা, টাকার আকাল। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঘুমোতে যাওয়ার আগে অব্দি তাদের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার প্রত্যেকটা অধিকার দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে।   

আমি এদের মুর্খ বলি। চুড়ান্ত অশিক্ষিত এরা। কেঁচোর মতো অমেরুদন্ডী প্রাণী এরা। দুঃখ হয় এদের জন্যে। করুণা হয়। বেঁচে থাকতে যারা মৃত, যাদের জ্ঞানচক্ষু ফোঁটেনি এখনো, তাদের করুণা ছাড়া কি ই বা করতে পারি? 

তবে হ্যাঁ, এক্সেপশন অবশ্যই আছে। কিছু ছেলে মেয়েকে দেখি ভালোছাত্রের মিথ পায়ের তলায় দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে, ক্যারিয়ারের তোয়াক্কা না করে সিস্টেম পাল্টানোর রাজনীতিতে ঝাপিয়ে পড়তে। মানুষের জন্যে, মানুষের হয়ে কাজ করতে। কিন্তু সেখানেও বৈষম্য আছে অবশ্যই। সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র তাদের বখে যাওয়া , উচ্ছন্নে যাওয়া, দেশদ্রোহী তকমা দেয়। কারন তাদের অপরাধ তারা এই সমাজে, এই ব্যবস্থায় বিশ্বাস হারিয়েছে। তবু এদের জন্যেই আশা জাগে আজোও। এদের জন্যেই স্বপ্ন দেখি - 

"আমাদের ক্ষেতগুলি পরের জিম্মা থেকে নিয়ে আসা হবে
আমাদের ইস্কুল কলেজ কারখানা
পরের জিম্মায় আর রাখতে দেব না।"

মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১৮

বিরসা মুন্ডা - এক শেষ না হওয়া লড়াইয়ের নাম
___________________________________________

"কেউ যদি আমাদের অরণ্য মাকে কেড়ে নিতে চায়, কেউ যদি আমাদের জাতিকে খারাপ বলে, কেউ যদি আমাদের ধর্মকে ধর্ম মনে না করে, কেউ যদি আমাদের শুধু শোষণ করে তবে আমি বিদ্রোহ করবই।"

আদিবাসীদের নিজস্ব জীবনের জন্য, জল-জঙ্গল-মাটির ন্যায্য অধিকারের জন্য
যিনি লড়াই করে জীবন দিয়েছিলেন, উনিশ শতকে যাঁর নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম আদিবাসী বিদ্রোহ অথবা বলা যায় অবিভক্ত ভারতবর্ষের প্রথম ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াই, এই কথাগুলো তিনিই বলেছিলেন। আজ তাঁর ১১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। ৯ই জুন ১৯০০ সালে জেলের মধ্যে খাবারে বিষ মিশিয়ে তাঁকে খুন করে তৎকালীন ইংরেজ সরকার।

তিনি বিরসা মুন্ডা। আদিবাসীদের কাছে ভগবান বিরসা। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ভোরের পাখি। এ রকম ভোরের পাখিদের কলকাকলীই তো বয়ে এনেছিল স্বাধীনতার সোনালি সকাল। দুঃখের বিষয় এটাই বিরসা মুন্ডা তথা মুন্ডা বিদ্রোহের ইতিহাস স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষের বেশীরভাগ ছেলেমেয়েই জানে না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথা নাহয় বাদ ই দিলাম। অবশ্য তাতে তাদের তেমন দোষ ও তো দেখি না। কারন বৃটিশ পরবর্তী ভারতবর্ষের ইতিহাস বিরসা দের চিরকাল ব্রাত্যই রেখেছে। পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাসে রাষ্ট্র শুনিয়েছে (এখনোও) মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী, নেহরু, প্রমূখ রাই ভারত নামক রাষ্ট্রটিকে স্বাধীন করিয়েছেন। (২০১৪ পরবর্তী ভারতবর্ষ অবশ্য নেহরু, গান্ধীদেরও খলনায়ক আখ্যা দিয়ে সাভারকরদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুন নায়ক হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে হাজির করিয়েছে)।  নিদেনপক্ষে ভারতীয় সিনেমা ভগৎ সিং, মঙ্গল পান্ডেদের নিয়ে সিনেমা করিয়ে বলেছে না না এঁরাও ছিলেন। কিন্তু উনিশ শতকে প্রথম বৃটিশ উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন যে আদিবাসী মুন্ডারা গড়ে তুলেছিলেন, সে কথা আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলো খুব সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছে। এখনো যায়। 

এর কারন হয়তো, মুন্ডা বিদ্রোহ মূলত ইংরেজদের বিরুদ্ধে হলেও আসলে তো এই বিদ্রোহের ভিত ছিল সর্বপ্রকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে। এবং সেই শোষক শুধুমাত্র বৃটিশ রা ছিল না, ভারতের ভিন্নভাষার, ভিন্ন বর্গের - বিহারি, পাঞ্জাবী, বাঙ্গালী, রাজপূত, জমির মালিকরা ও ছিল। আদিবাসীদের ভাষায় 'দিকু'। এরা আদিবাসীদের নানাভাবে শোষন করতো। চড়া ঋণের দায়ে ফেলে, সুদের জালে আটকে তাদের জমিজমা কেড়ে ভূমিদাসে পরিণত করত। আজ ও করছে। হয়তো জমিদারি প্রথার বদলে কর্পোরেট আদলে। কেড়ে নিত বা নিচ্ছে তাদের জল-জমি-অরণ্যের অধিকার। খাবার, ঘরবাড়ী, জমি, জঙ্গল হারিয়ে অসহায় হয়ে টাঙি, বর্শা নিয়ে রাষ্ট্রের গুলির সামনে এসে দাড়াতে হয় তাদের আজ ও। তাই এদের কথা রাষ্ট্র তার পাঠ্যপুস্তকে দিতে ভয় পায়। তার নাগরিকদের জানাতে ভয় পায়।

বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট এবং বিদ্রোহ ...
______________________________

ঊনিশ শতকের গোড়ার দিক।  মুন্ডারা দেখল তাদের পরিষ্কার করা জমি বণিক ও মহাজন বেশে আসা জায়গিরদার ও ঠিকাদারের হাতে ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। মুন্ডাদের জমি হারানোর এই প্রক্রিয়া ব্রিটিশদের ভারতে আসার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল কিন্তু ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার  সাথে সাথে আদিবাসী অঞ্চলে অ-আদিবাসীদের আসা-যাওয়া ভীষণভাবে বৃদ্ধি পায়। সাথে বাড়তে থাকে বলপূর্বক শ্রম এর ঘটনা। একদিকে  মহাজন ও জমিদারদের অকথ্য অত্যাচার, নির্যাতন,  অপরদিকে বৃটিশ সরকারের উচ্চহারে কর আদায়। একদিকে অনাহারে মানুষের দিন কাটছে অন্যদিকে খাদ্যের লোভ দেখিয়ে একশ্রেণীর মিশনারিরা মুন্ডাদের খ্রীষ্টান ধর্মে ধর্মীন্তরিত করার প্রবল চেষ্টা চালাচ্ছে। বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে তখন শুরু হয়  গ্রামের পতিত জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলন।

সমস্ত  দেশের অসংখ্য আদিবাসীরা একে একে বিরসা মুন্ডার ডাকে সাড়া দিয়ে বিদ্রোহে সামিল হয়। ভয় পেয়ে বৃটিশ সরকার বিরসা মুন্ডাকে  সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করে  এবং  শেষে  ১৮৯৫ সালে বিরসা মুন্ডাকে  দুবছরের জন্য কারাগারে বন্দি করে। মহাজন, জায়গীরদাররা মুন্ডাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে।

জেল থেকে বেরিয়ে বিরসা মুন্ডা নতুন কূটনীতির আশ্রয় নেন। এক গভীর জঙ্গলে নৈশ ভোজন করার জন্য জায়গীরদার, মহাজন,  হাকিম ও খ্রিষ্টানদের আমন্ত্রণ করেন তিনি। একদিকে ভোজের আয়োজন তার সাথে আদিবাসীদের গান ও সুরা এসবের মধ্যেই বিভোর হয়ে থাকে তারা। অন্যদিকে বিরসার ইশারায় ঝোপঝাড়ের মধ্যে থেকে উড়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর। মুহূর্তের মধ্যে প্রাণ হারায় বেশ কয়েকজন জায়গীরদার, মহাজন, হাকিম ও মিশনারি।

ব্রিটিশদের অমানুষিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে ১৮৯৯ সালে বড়দিনের আগে মুন্ডারা রাঁচি ও সিংভূম জেলার ছয়টি থানায় আগুন লাগায়। এই কান্ডকলাপে ব্রিটিশরা বিরসার উপর আরও খেপে ওঠে এবং চরম প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। বিরসা মুন্ডা সহ তার সমগ্র বিপ্লবী দলকে বন্দী করতে সমর্থ হয় ব্রিটিশ সরকার। চারিদিকে তখনও বিক্ষিপ্তভাবে চলছিলো মুন্ডা বিদ্রোহীদের আন্দোলন। ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলনকে একেবারে নির্মূল করার জন্য ৩০০ র উপর বিদ্রোহীকে হত্যা করার পাশাপাশি অসংখ্য বিদ্রোহীকে কারারুদ্ধ করে। বিরসা মুন্ডাকে জেলের মধ্যেই খাবারে বিষ মিশিয়ে হত্যা করা হয়। 

রাজা আসে রাজা যায়, চরিত্র থাকে একই ...
___________________________________

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রথম দশক থেকেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের যে ভীত রচিত হয়েছিল তার সামনের সারিতে ছিলেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের লড়াকু মানুষেরা। "বাবা তিলকার লড়াই"  (১৭৭৫-৮৫), "সিদো-কানহুর হুল" (১৮৫৫-৫৬), "বীরসা মুন্ডার উলগুলান" (১৮৭২-১৯০০), "ভগীরথ মাঝি এবং জ্ঞান পারগনানার আন্দোলন", "দুবিয়া গোঁসাইয়ের খেরওয়াল আন্দোলন" (১৮৮০) সেদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।

অথচ সভ্য ভারতবর্ষ তার অরণ্যের কালো ছেলে- মেয়েগুলোকে  ঠিক আপন বলে চিনতে পারেনি আজোও। এদের অভাব-অভিযোগের নালিশকে বর্বর, কালা আদমির অভ্যুত্থান বলে নাক সিটকেছে। কখনো উগ্রপন্থী, মাওবাদী তকমায় ভূষিত করেছে এদের বেঁচে থাকার লড়াইকে। নিজের অধিকার আদায়ের লড়াইকে। ঋকবেদেও দেখা যায় এদের রাক্ষস, অসুর, জন ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। সুতরাং একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় সভ্যতার শুরু থেকে আজ অব্দি ভারত নামক ভূখন্ডের আদি বাসিন্দারাই সবচেয়ে বেশী অবহেলা, নির্যাতন আর শোষনের শিকার। বৃটিশদের হাতেও শোষিত হয়েছে এরা আবার নিজ ভূখন্ডের অন্যান্য বাসিন্দাদের হাতে আজোও শোষিত হয়ে যাচ্ছে।

সংবিধানের ৩৪২ (১) নং ধারায় আদিবাসীদের অধিকারের বিভিন্ন কথা ফলাও করে লিপিবদ্ধ করা আছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল সেগুলি আছে শুধু কাগজে কলমেই। স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও কেড়ে নেওয়া হয় তাদের পাট্টা, বর্গা, ফাঁসানো হয় মিথ্যা মামলায়! বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রকল্পে বহু সংখ্যক আদিবাসী বিনা ক্ষতিপূরণ বা নামমাত্র ক্ষতিপূরণে উৎখাত হোন নিজেদের জমি থেকে। ভারতীয় সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে আদিবাসী এলাকার দখলে থাকা  জমি হস্তান্তরে গ্রাম সভার অনুমতি বাধ্যতামূলক। কিন্তু সংবিধানকেও বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কোন প্রকার অনুমতি ছাড়াই শিল্প স্থাপন ও খনিজ উত্তোলনের জন্য কেন্দ্র ও অনেক রাজ্য সরকার বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানি, কর্পোরেট সংস্থাকে দিয়ে যাচ্ছে!

তাই আজকের সময়ে দাড়িয়ে আবার একজন বিরসা মুন্ডার খুব প্রয়োজন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর হাত থেকে নিজেদের জল-জমি-অরণ্যের অধিকার ছিনিয়ে আনতে আরেকটা উলগুলান আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাক আগামীর বৃহত্তম লড়াইয়ের ময়দানে। সংঘবদ্ধ করে তুলুক আমাদের।

শেষ করা যাক শবর সম্প্রদায়ের একটা গান দিয়ে -

"বাস করি ধুঁদে ঝাড়ে
ব্যাঙ, ইঁদুর মারে খাই
বোইল্যে দে-ন ভাই
ইটাকে কি বাঁচা বলা যায়?
বন-বাদাড় হ'রে ‍‌লিল-শিকড় বাকড় ফুরাঞ গেল
কেমন ক'রে কাল কাটাই?"

রবিবার, ৩ জুন, ২০১৮

জগাই'র পরীক্ষা বেত্তান্ত
***********************

কোনো এক অখ্যাত কারনে স্কুল হইতে শুরু করিয়া সমস্ত জেলায় এমন কেহই ই নাই, যে জগাই কে চেনে না!  যে মুখচোরা, গরুর মতো নিরীহ ছেলেটি বা মেয়েটি কাহাকেও চিনে না, কাহাকেও জানে না, সেও সবার আগে জগাইকে চিনিয়া লয়। কারন তার কথাবার্তা, ব্যবহার, মুখের চেহারায়, পোশাক পরিধানে এমন কিছু আছে, যাহা দেখিয়া সবাই বুঝিতে পারে এই মেয়েটিই জগাই। তাহার চোখদুটি অসম্ভব রকমের ছোটো এবং মাথায় চুলের বদলে এক বস্তা তামার তার চতুর্দিকে স্প্রিং এর মতো ছড়াইয়া ছিটাইয়া পড়িয়াছে। সে যখন রাগ করিয়া তাহার ছোট ছোট চোখদুটিকে আরো ছোটো করিয়া মাথার তামার তারগুলি ঝাকাইয়া ঝগড়া করিতে করিতে চিংড়ি মাছের মতো হাত পা ছুঁড়ে, তখন ওপাড়ার গবা পাগলাও নিশ্চিত হইয়া যায়, এ জগাই ই!  ছোটবেলা হইতেই কোনো এক অজানা কারনে জগাই'র মা জগাইকে 'বৃটিশ' বলিয়া ডাকেন..!! জগাই বহুবার তাহার মাকে বহুভাবে  জিজ্ঞাসা করিয়াও সেই ডাকের রহস্য ভেদ করিতে পারে নাই। যাহা হউক সে বেত্তান্ত নাহয় আরেকদিন বলা যাইবে। এক্ষনে তাহার পরীক্ষা বেত্তান্ত বলা যাক। 

জগাই সারাজীবন পরীক্ষাকে যমের মতো ভয় পাইয়া আসিয়াছে, কিন্তু তাহার জীবনেই বারবার পরীক্ষা নামক যমদেবতাটি ঘুরিয়া ফিরিয়া আসে। সারাজীবন প্রতিটা পরীক্ষা দিয়া সে মনেমনে নিশ্চিত থাকে সে ফেইল করিবে, কিন্তু কিভাবে যে সে পাশ করিয়া ফেলে তাহা সে নিজেও বলিতে পারে না। 

মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে জগাই তাহার ইলেক্টিভ সাবজেক্ট লইয়াছিলো ইতিহাস। তখন সমগ্র জেলার অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রী ইলেক্টিভ সাবজেক্ট লইয়াছিল ঐচ্ছিক অঙ্ক/সংস্কৃত/হিন্দি। ইতিহাস কেহ ই নেয় নাই, যার দরুন ইতিহাস বই ও লাইব্রেরীতে আসে নাই। জগাই  প্রথম তিন চার মাস খোঁজ লইয়া যখন দেখিল ইতিহাস বই আসার আর কোনো চান্স ই নাই, তখন সেও হাল ছাড়িয়া  তাহার অন্যান্য কাজে মনোনিবেশ করিল। সারাবছর ঘরের সবার বিশেষত মা- বাপী-মেজদির সব বকা-মার-মানসিক হেনস্তা- তাচ্ছিল্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাইয়া  জগাই নাচিয়া কুদিয়া, সিনেমা দেখিয়া, ঝগড়া করিয়া, হো হো করিয়া হাসিয়া, রাক্ষসের মতো খাইয়া -দাইয়া, অক্টোপাসের মতো হাত পা ছুড়িয়া ঘুমাইয়া কাটাইলো। যথারীতি পরীক্ষা আসিল এবং জগাই সকালে মায়ের হাতের শিঙি মাছের ঝোল দিয়া হাপুস হুপুস করিয়া ভাত খাইয়া, মাথায় তেল দিয়া বাপীর হাত ধরিয়া পরীক্ষা দিতে গেল। প্রশ্ন দেখিয়া জগাই প্রথমে ভয় পাইলো, তারপর সেই ভয়কে ফেইস করিয়া সে লিখিতে বসিল। জগাই লিখিল। যাহা তাহার মনে আসিল সে লিখিয়া গেল। পরীক্ষার ফাইনাল ঘন্টা বাজার আগে সে পাশের ছেলেটির খাতার দিকে একবার এমনিই চাহিয়া ছিলো, কিন্তু ইনভিজিলেটর জগাইর চাওয়াকে সন্দেহের চোখে দেখিলেন এবং তাহাকে কড়া চোখে ধমক দিলেন। জগাই দাঁতে দাঁত চাপিয়া ক্রোধ সংবরণ করিল। যাহাহউক, এভাবে ইতিহাস পরীক্ষায় ও সে লিখিল। মোগল সম্রাট  ঔরঙ্গজেব সম্পর্কে বড় প্রশ্নটির উত্তর লেখিয়া নিজের ক্রিয়েটিভিটি দেখিয়া জগাইর  নিজেকে নোবেল প্রাইজ দিতে ইচ্ছা জাগিল। 

যথারীতি পরীক্ষার ফলপ্রকাশের দিন আসিল। ঘরের সবাই নিশ্চিত জগাই ফেইল করিবে। জগাই ও নিশ্চিত। সকাল হইতেই সে বুঝিতেছে ঘরের সবাই তার দিকে কেমন যেন অদ্ভুত চোখে তাকাইতেছে। জগাই ভাব সুবিধের নয় বুঝিয়া  সকাল সকালই রান্নাঘরে গিয়া ভাত এবং আর যা যা ছিলো তা খাইয়া ফেলে কারন রেজাল্টের পর যে তাহার ভাগ্যে মার ছাড়া আর কিছুই জুটিবে না, তাহা সে বিলক্ষন জানিত। বেলা এগারোটার দিকে মা-বাপী-মেজদি তিনজন গেলেন জগাইর রেজাল্ট দেখিতে। লিস্টের শেষ থেকে দেখা শুরু করলেন তিনজনাই। কারন তারা জানিতেন উপর দিকে দেখা জগাইর ক্ষেত্রে বৃথা। কিন্তু লিস্টের শেষে মানে থার্ড ডিভিশনে যখন দেখিলেন জগাইর নাম নাই, তখন মা-বাপী ফিরিয়া আসিতে উদ্যত হইলেন। মেজদি কোন এক অজানা কারনে আরেকটু উপর দিকে দেখলো, তারপর আরেকটু উপরে দেখলো জগাইর নাম মিটমিট করিতেছে। ওদিকে জগাইর টেনশনে অথবা অতি খাওয়ার ফলে পেটখারাপ হইয়াছে। সে টয়লেট আর ঘরে পর্যায়ক্রমে দৌড়াইতেছে। এমন সময় দেখে তাহার যমের মতো বাবা মিষ্টির প্যাকেট লইয়া ঘরে ঢুকিতেছেন, পেছনে একগাল হাসিয়া তাহার মাতৃদেবীও..! জগাই যখন বুঝিলো পিঠে মার নাই, জগাই অতিরিক্ত ভাব দেখাইয়া বলিল, "কি? খুব তো বলেছিলে ফেইল করবো, এখন কি?" বলিয়া দুপদাড় করিয়া নিজের রুমে ঢুকিয়া হো হো করিয়া উপুড় হইয়া হাসিল অনেকক্ষণ। কেন হাসিল তাহা সে নিজেও বুঝিতে পারে নাই।

উচ্চমাধ্যমিকও একই রকম কাটাইলো জগাই। সে নির্ঘাত জানিত ইকোনমিক্সে ফেইল করিবে। ঘরের সবাই ও নিশ্চিত ছিলো মাধ্যমিক উতরে গেলেও উচ্চমাধ্যমিক উতরানো এর কম্মো নয়। যথারিতী রেজাল্টের দিন ও মাধ্যমিকের পুনরাবৃত্তি ঘটিলো। জগাই দন্তবিকশিত করিয়া গ্রাজুয়েশনে ভর্তি হইলো। জগাইর ইচ্ছা ছিলো ফিলসফি নিয়ে পড়বে, জগাইর রাগী পিতৃদেব তাহাকে ইংলিশ অনার্স দিয়া ভর্তি করাইলেন। জগাই প্রথমে প্রতিবাদ করিয়াছিল, কিন্তু দু-তিনটে চড় থাপ্পড় খাইয়া সে জেদ তাকে ছাড়তে হলো। জগাই ক্লাসে যায়, কিন্তু কিছুই সে বুঝিতে পারে না। জগাই ইংলিশ অনার্সের বই রাখিয়া অফ পিরিয়ডে লাইব্রেরীতে বসিয়া "কালবেলা" পড়ে, ফ্রয়েড পড়ে, ইমানুয়েল কান্ট পড়ে, ভারতীয় দর্শনের বই পড়ে। বাড়ীতে আসিয়া নাক ডাকাইয়া ভোস ভোস করিয়া ঘুমায়, তারপর রাত জাগিয়া কম্পিউটার গেম খেলে।  ক্রমে পরীক্ষা আসিল। জগাই  পরীক্ষার আগের রাতে মনোযোগ সহকারে দিদির মোবাইলে "ব্লক পাজল্" গেম খেলিল। পরীক্ষার হলে  প্রশ্ন দেখিয়া জগাই ভাবিল পাস মার্ক তোলা যাইবে। জগাই লিখিতে বসিল, কিন্তু অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাসে লিখিতে বসিয়াই তাহার চোখে ভাসিয়া উঠিল ব্লক পাজল গেইমের "লাল-নীল গুটি"। জগাই চোখ বন্ধ করিয়া ভাবিতে বসিল। সব মনে আসে জগাইয়ের, কবে কাকে মুরগি বানিয়েছিল, কিভাবে রান্নাঘরে ঢুকিয়া কড়াই হইতে  চিংড়ি মাছ ভাজা সব খাইয়া বেড়ালের উপর দোষ ফেলিয়াছিল, কিভাবে বড়দির প্রসাধন বাক্স হইতে  মুখে মাখার ক্রিম চুরি করিয়া মেজদির ঘাড়ে দোষ ফেলিয়া বড়দি মেজদির ডব্লিউ ডব্লিউ ই লাইভ দেখিয়াছিল, কিভাবে ছোটোবোনের পয়সা জমানোর মাটির ঘট হইতে নরুন দিয়ে টাকা বের করিয়াছিল, কিন্তু প্রশ্নের উত্তর তাহার মনে আসে না। কোনোরকম যাহা মনে আসিল টুকরো টাকরা ভাবে, সে তাহাই লেখিল।  এইভাবে তিনটে বছর কাটাইয়া সে কোনোক্রমে গ্রাজুয়েশন পাস করিল। তাহার পর এম. এ ও পাশ করিল। 

এম. এ করিয়া জগাই ভাবিয়াছিল আর তাহাকে পড়িতে হইবে না। পরীক্ষায়ও বসিতে হইবে না। কোনোমতে স্কুলে একটা চাকরী জুটাইয়া জগাই মনের সুখে তাহার কাজকর্ম চালাইয়া যাইতে লাগিল। কিন্তু ভাগ্য জগাইর এই অবস্থা মেনে লইবে কেন! আবার ডি.এল.ইডি নামক এক পরীক্ষা আসিয়া তাহার জীবনে উপস্থিত হইলো। জগাই শুনিলো ডি এল ইডি খুব সহজ, না পড়িলেও তাতে পাশ করা যায়। জগাই তাহাই বেদবাক্য বলিয়া ধরিয়া লইলো। সারাবছর সে ফেইসবুক করিয়া, লোকজনের পোষ্টে পোষ্টে গিয়া তাদের খিস্তি দিয়া, ছবি আঁকিয়া, গেইম খেলিয়া, হি হি করিয়া, নিয়ম ছাড়া খাইয়া, সিগারেট ফুকিয়া, ইস্কুলে গিয়া, সিরিয়াস মুখে ছাত্র-ছাত্রীদের উপদেশ বাণী ঝাড়িয়া দিন কাটাইলো। পরীক্ষার আগের রাতে বইখাতা মেলিয়া তাহার উপরে অক্টোপাসের মতো হাত পা ছুড়িয়া সে ঘুমাইলো এবং পরদিন গাড়ী করিয়া পরীক্ষা দিতে গেল। পরীক্ষা হলে দেখিলো তাহার ই এক ছাত্রী তাহার আগের ডেক্সে বসিয়াছে। এবং ছোটোবেলা যে ছেলেটার মাথা ব্যাট দিয়া ফাটিয়েছিল, সে তাহার নিজের ডেক্সে বসিয়াছে। জগাই যে কাউকে একটা ছোটো প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞেস করিবে, সে উপায় ও নাই। কারন তাহার এই ছাত্রীটিকে সে পড়ালেখা যে কত সহজ এবং পরীক্ষা হলে যে নিজের খাতার দিকে চেয়ে লেখতে হয়, সে সম্পর্কে একদা অনেক জ্ঞান ঝাড়িয়াছিল। যাইহোক, জগাই প্রথমে ছোট প্রশ্ন গুলো লিখিল। বড় প্রশ্ন দুইটা তাহার জানা ছিলো, সেইগুলি সুন্দর করিয়া ব্যাখ্যা করিয়া ফিক ফিক করিয়া হাসিয়া হাসিয়া লিখিতে লিখিতেই দুই ঘন্টা পার হইয়া গেল। বাকী এক ঘন্টা সে পাঁচ মার্কের ছয়টা প্রশ্নের মধ্যে মাত্র তিনটে কোনোমতে লিখিতে পারিল। একটা প্রশ্নের উত্তরের জন্যে পিছনের জনার খাতার দিকে একবার মোটে তাকিয়েছিল, কিন্তু যেই দেখলো ওর ছাত্রীটি ওর দিকে দেখিতেছে, সে তাড়াতাড়ি সোজা হইয়া বসিল। বাকী দুদিনের পরীক্ষা ও একই রকম গিয়াছে। সে এখনো নিশ্চিত নয় সে পাশ করিতে পারিবে কি না।  যাহাহউক, পরীক্ষা দিয়া সে প্রতিদিনই আপন মনে 'লাল গানে নীল সুর, হাসি-হাসি গন্ধ ' গাহিতে গাহিতে বাড়ী ফিরিয়াছে। নিন্দুকেরা তাহা দেখিয়া ভাবিয়াছে না জানি তাহার পরীক্ষা কতই না ভালো হইয়াছে!!

শনিবার, ২৬ মে, ২০১৮





চেতনায় নজরুল
________________

অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, ‘আর-সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে/ভাগ হয়নি কো নজরুল’। 

তাই ই তো। নজরুল এমন একজন মানুষ যাকে ধর্ম কিংবা জাত কিংবা মানচিত্র দিয়ে কখনো ভাগ করা যায়নি। আমাদের কাছে নজরুল যেমন স্মরণীয়, বাংলাদেশেও তো তাই। বরং অনেকক্ষেত্রে আমাদের থেকে অনেকটা বেশী তিনি বাংলাদেশে বরণীয়। বলছি কারন আমাদের দেশে রবি ঠাকুরকে নিয়ে যেরকম হইহুল্লোড়, নজরুলের ক্ষেত্রেসেটা যেন  অনেকটাই ম্রিয়মান। 

এদেশের একটা শ্রেণী তাকে খানিকটা অবহেলা করলেও উপেক্ষা করার স্পর্ধা করতে পারেনি। এর কারন নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানবতাবোধ। তাঁকে কোনো বিশেষ ধর্মের আওতায় ফেলার চেষ্ঠায় বারবার হেরে যায় তাই এরা। ধর্ম বর্ণের উর্ধ্বে উঠে নজরুল উচ্চারন করেছিলেন -

 "গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, 
নহে কিছু মহীয়ান।"

একদিকে যেমন তিনি ইসলাম নিয়ে প্রচুর লিখেছেন, তেমনি শ্যামা সঙ্গীতও রচনা করেছেন অনেক। ধর্মের উর্ধ্বে উঠে মানুষের "মানুষ" পরিচয়ই প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর কাছে। এর প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই তাঁর চার সন্তানের নামেও। কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। নিজের আত্মজদের নামের মধ্যে দিয়ে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ ভুলে দুই ধর্মের মানুষের একাকার হয়ে ওঠার সামান্য হলেও বাস্তবায়ন। কোনো এক ভাষনে নজরুল বলেছিলেন -  

"কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি, ও দুটোর কোনোটাই নয়। আমি শুধু হিন্দু মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করছি।"

এহেন এক অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্বকে রাজনৈতিক-ধর্মীয়-বর্ণীয়- ইত্যাদি নোংরা এজেন্ডা দেখিয়ে অবহেলা করে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে ভারতীয় বাঙ্গালী সমাজ, কিন্তু তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করার স্পর্ধা তাদের আজকের সময়েও নেই। সারা জীবন তিনি সংগ্রাম করেছেন শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে। নির্ভীকচিত্তে গেয়েছেন মানবতার জয়গান। দারিদ্র্যের চুড়ান্ত কশাঘাত সহ্য করেছেন, ভোগ করেছেন নির্যাতন-নিপীড়ন; কিন্তু ব্যক্তিগত লোভ-লাভ-খ্যাতির মোহের কাছে কখনো আত্ম-বিক্রি করেনি। ধর্মান্ধ মুসলামানরা একদিকে ফতোয়া দিয়েছে কাফের বলে। অন্যদিকে  ধর্মান্ধ হিন্দুরা খেতাব দিয়েছে "পাতি নেড়ে"। তাতেও দমেননি নজরুল; সবার উপর মানুষ সত্য এই মর্মবাণী তাঁর কণ্ঠে ভাস্বর হয়েছে বারবার। তিনি  মানুষকে জাগিয়েছেন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে, শোষণের শৃঙ্খল ভাঙার আন্দোলনে। আর এখানেই তিনি সমকালের দাবি মিটিয়েও চিরকালীন।

নজরুলের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল ঘরের দেয়ালে টাঙানো একটা ছবি দেখে। ঘাড় অব্দি লম্বা চুল নিয়ে একজন মানুষ বিষন্ন চোখে তাকিয়ে আছেন ঈশান কোনের দিকে। মা না বাপী (ঠিক মনে নেই এইমূহূর্তে) কাকে যেন জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন ইনি নজরুল ইসলাম। ক্লাস টু তে উঠে আরেকটু পরিচয় তাঁর সাথে। রঙচঙে একটা বই হাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়ছিলাম - 

"ভোর হলো দোর খোল
খুকুমনি ওঠে রে,
ঐ ডাকে জুঁই-শাখে
ফুল-খুকি ছোট রে।"

তারপর থেকে ক্লাস ফাইভ সিক্স অব্দি কেউ যদি জিজ্ঞেস করতো আমার প্রিয় কবিতা কোনটি, আমি চোখ গোলগোল করে "প্রভাতী" বলেই তৎক্ষণাৎ কবিতাটা বলতে শুরু করে দিতাম। "লিচুচোর" যখন পড়লাম তখন সেটা প্রিয় হয়ে গেল....

"যাবো ফের? কান মলি ভাই
চুরিতে আর যদি যাই,
তবে মোর নামই মিছা।
কুকুরের চামড়া খিঁচা
সে কি ভাই যায়রে ভুলা-
মালীর ওই পিটনী গুলা,
কি বলিস? ফের হপ্তা?
তওবা, নাক খপ্তা।" - লাইনগুলো পড়তে পড়তে আমি তখন সেই ডানপিটে ছেলের শাস্তির বহর শুনে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছি..! তারপর একে একে "খুকি ও কাঠবেড়ালী",  ‘ঘুমপাড়ানী গান’, ‘পুতুলের বিয়ে', 'চড়ুই পাখির ছানা' সহ অসংখ্য কবিতা প্রিয় হয়ে উঠলো। স্কুলে পড়া না শিখে যাওয়ায় দিদিমনির গালি খেয়ে বাড়ী ফিরতে বিড়বিড় করছি নজরুলের লাইন -

 "ঝাঁকড়া চুলো তালগাছ, তুই দাঁড়িয়ে কেন ভাই?
আমার মতন পড়া কি তোর মুখস্থ হয় নাই?"

ক্লাস নাইনে উঠে পড়লাম নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতা। 'অগ্নিবীনার' ছোট ফন্টে ছাপানো আট পৃষ্ঠার কবিতা - 

"আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন।
আমি চির-বিদ্রোহী-বীর-
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির!" - লাইনগুলো পড়তে পড়তে রক্তচাপ বেড়ে যেত আমার। বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক জোর আছড়ে পড়তো..! নজরুলের সাথে প্রেমের শুরু তখন থেকেই। স্কুল থেকে ফিরে খেয়েদেয়েই "অগ্নিবীনা" খুলে বসতাম। এবং কদিন পর দেখলাম "অগ্নিবীনার" বেশীরভাগ কবিতাই আমার মুখস্থ। 

'অগ্নিবীনা' পড়ে যত না তাঁর প্রেমে পড়েছিলাম, তারচেয়ে দ্বিগুন প্রেমে পড়েছিলাম "সাম্যবাদী"র 'মানুষ' পড়ে । -

"কোথা চেঙ্গিস, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙ্গে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার!"

এই দুই লাইনে কি ছিলো তখন বুঝতাম না, কিন্তু  এটুকু বলতে পারি এই দুটো লাইন থেকেই আমার যাবতীয় চিন্তার সুত্রপাত। 

নজরুল ছিলেন মনেপ্রাণে বিদ্রোহী। তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতায় যে তীব্র প্রতিবাদের জোয়ার উঠেছিল, তা থামাতে ইংরেজ সরকার তাঁকে জেলে পুরেছিল। নজরুলের আগেও কিছু বাঙ্গালি কবির ভাগ্যে রাজরোষ জুটেছিল, তবে তাঁর মত এত তীব্রভাবে কাউকে আক্রমণ করা হয়নি।  ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশের কিছুদিন পরেই তা বাজেয়াপ্ত করেছিল ইংরেজ সরকার। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ ব্যান করে।

জেলে বন্দী অবস্থায় ও নজরুল তাঁর প্রতিবাদী সত্ত্বাকে বিসর্জন দেননি। জেলখানায় কারাবন্দীদের সঙ্গে নির্যাতনমূলক আচরণ, বৈষম্য ও রাজবন্দীর প্রাপ্য মর্যাদা না দেয়ায় প্রতিবাদে তিনি অনশন শুরু করেন। সারা ভারতবর্ষে তুমুল আলোড়ন তুলে ঘটনাটি। এ সময়ই রবিঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ গ্রন্থ নজরুলকে উত্সর্গ করে বলেছিলেন, -

 ‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল তাই আমার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থখানি ওকেই উতসর্গ করছি’। 

সম্ভবত এই সময়ই রবি ঠাকুর নজরুলকে অনুরোধ করে বলেছিলেন, ‘সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগাবার কবিও তো চাই’।

নজরুল ছিলেন দ্রোহ ও প্রেমের কবি। তাঁর কবিতায়, গানে বিদ্রোহ ও প্রেমের দ্বৈত ছবি একইসঙ্গে ধরা দিয়েছে। বিদ্রোহের আগুনে পুড়লেও শাশ্বত প্রেমের আহ্বানকে উপেক্ষা করেননি কখনোই। একদিকে যুদ্ধজাহাজে যাত্রা অপরদিকে ভেলা ভাসিয়েছেন প্রেমের সাগরেও। আর সেজন্যই "বিদ্রোহী প্রেমিক" শব্দবন্ধটি নজরুলের ক্ষেত্রে শতভাগ সত্য। 

একদিকে তাঁর বিদ্রোহী সত্ত্বা ঝঙ্কার তুলছে -

"মহা প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন,
আমি ধ্বংস
আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার।"

অন্যদিকে তাঁর প্রেমিক সত্ত্বা বলছে - 

"মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী
দেব খোঁপায় তারার ফুল।।"

একইসঙ্গে দ্রোহ ও প্রেমকে ধারণ করে এমন স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ শুধুমাত্র  নজরুলের পক্ষেই সম্ভব।

রবীন্দ্র সঙ্গীত আমার প্রতি দিনের সঙ্গী। কিন্তু নজরুলের গানের যে শব্দ ঝংকার আছে, তা রবীন্দ্রনাথের গানে পাইনি। রবি ঠাকুরের গান হৃদয়ে গিয়ে লাগে, আর দুখু মিয়ার গানের প্রতিটি শব্দ একদম মস্তিষ্কের ভিতরে গিয়ে লাগে। - 

“শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে” 

অথবা 

"আধো আধো বোল লাজে বাধো বাধো বোল ব'লো কানে কানে যে কথাটি আধো রাতে মনে জাগায় দোল ব'লো কানে কানে"

 "ভুলি কেমনে আজো যে মনে বেদনা-সনে রহিল আঁকা
 আজো সজনী দিন রজনী সে বিনে গণি তেমনি ফাঁকা"

নজরুলের এইসব গানগুলি আমাকে ভাবায়। তাঁর দ্রোহী স্বত্ত্বার সাথে তাঁর এই মহান প্রেমিক হৃদয়ের সহাবস্থান - ভাববার বিষয় বৈকি। 

তাঁর আরেকটা গান - 

 “আমি চিরতরে চলে যাবো 
তবু আমারে দেবো না ভুলিতে
আমি বাতাস হইয়া জড়াইবো কেশ বেণী 
যাবে যবে খুলিতে 
তবু আমারে দেবো না ভুলিতে” - 

শুধু দ্রোহ নয় প্রতিবাদ নয় বরং জীবনের মৌলিক ও নান্দনিক অনুভুতিগুলোর সংমিশ্রনে নজরুল যে কতটা অনিবার্য তা তাঁর এইসব হৃদয়স্পর্শী গানগুলো শুনলে কিছুটা হলেও বোঝা যায়। আর মানবিক অনুভুতিগুলোকে যাঁরা এমনতর ভাষাময় করে তুলতে পারেন তাঁদেরকে কি ভোলা যায়? … যায় না। আর তাই নজরুলকেও ভোলা সম্ভব নয়। আগামী কয়েক প্রজন্ম, কয়েক দশক অব্দি, তাঁকে ছাড়া বাঙালির চলবে না। চলা সম্ভব নয়। 

প্রিয় কবি, আপনার কাছে একটা বিষয়ে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। মাধ্যমিক অব্দি  যখন ই পরীক্ষায় রচনা লিখতে হত 'আমার প্রিয় কবি', আমি কখনই আপনার নাম লিখতে পারিনি। লিখেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমার ক্লাসের সবাই "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর" লিখতো বলেই হয়তো। অথবা প্রাইভেট স্যার "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের" রচনাতেই জোর দিতেন বলেই হয়তো! কিন্তু মাধ্যমিকের খাতায় আমি লিখতে পারিনি শুধু রবি ঠাকুর নন, আপনিও  আমার সবচেয়ে প্রিয় কবিদের একজন। 

শুভ জন্মদিন। শুভ জন্মদিন দুখু মিয়া।

শুক্রবার, ২৫ মে, ২০১৮


ধর্ষণ
*********

‘ধর্ষণ’ - নারীর ওপর পুরুষের বলপ্রয়োগের চুড়ান্ত রূপ। একজন মানুষকে কীটপতঙ্গেরও  মর্যাদা না দেবার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ধর্ষণ। তার ইচ্ছে অনিচ্ছের তোয়াক্কা না করে তার উপর নিজের পৌরুষিক ক্ষমতা দেখানোর বিকৃত রূপ হচ্ছে ধর্ষন। 

ধর্ষন বর্তমান সময়েই যে শুধু হচ্ছে তা কিন্তু নয়। প্রাচীন কাল থেকেই তা চলে আসছে, সে গ্রীক পুরাণ ই হোক বা উপাখ্যান , দেবতা হোক বা নবী। মানব সভ্যতার ইতিহাস ধর্ষণের ইতিহাস লিখে রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। বরং বিভিন্ন প্রাচীন উপাখ্যানে ধর্ষণকে অনেকটা ধর্ম এবং দর্শনের মোড়কে দেখানো হয়েছে। গ্রীক পুরাণ জুড়ে দেখা যায় নারীর শরীর পুরুষের কাম প্রশমিত করার বস্তু। তাকে আক্রমন করা যায়, লুঠ করা যায়, যদি না তার আক্রমনকারীকে প্রতিহত করার কোনো চরম উপায় না থাকে। সেই উপায়টি কি? উপায়টি হচ্ছে নারীর স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণ। মৃত্যুই বাঁচাতে পারে নারীর সম্ভ্রম!! এইকথাটি যে শুধু গ্রীক পুরাণেই সীমাবদ্ধ -তা তো নয়! আমরা এই প্রাচীন ভারতবর্ষেও দেখেছি "জৌহর"। আলাউদ্দিন খিলজীর কামনার হাত থেকে বাঁচতে পদ্মাবতী তার সহচরীদের নিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেছিলেন। এবং ভারতীয় সমাজে তা নারীর সতিত্বের বিজয়গাঁথা হিসেবে আজোও পালিত হয়ে আসছে! আমাদের ইতিহাসটার  দিকে একবার তাকান - স্বামীর অপমান হলে রাজসভায় প্রাণ দেওয়ার নাম সতীত্ব। স্বামী মরলে তার সাথে সহমরণে যাওয়ার নাম সতীত্ব। কি মর্মান্তিক! শুধু যে প্রাচীন উপাখ্যান-তাও তো নয়! আমাদের সিনেমাগুলোতেও কি দেখছি আমরা? নায়িকা ভিলেনের লালসার শিকার হয়ে নিজেকে বাঁচাতে বুকে ছুরি তুলে বলছেন "জান দেব, তবু ইজ্জত দেব না"! মানে ঘরে ঘরে আমাদের মেয়ে এবং ছেলেদের ও বুঝিয়ে তোলা হচ্ছে- নারীর প্রাণের মূল্যের চেয়েও ইজ্জতের মূল্য বেশী! নারীর শরীর শেষ মানে নারীর জীবন শেষ! 

যাইহোক, পৌরানিক ধর্ষনের ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন, তা প্রমাণ করে ধর্ষণের ইতিহাস মানব সৃষ্টির ইতিহাসের সমসাময়িক। ব্রাউনমিলার বলেছিলেন, " শুরুতে পুরুষ ছিলো প্রাকৃতিক লুন্ঠনকারী আর নারী ছিলো প্রাকৃতিক শিকার"। 

পৃথিবীতে নারী জন্মের শুরু থেকেই এই অমানবিক আক্রমণ/হিংসাটি বা হিংসার সম্ভাবনাটি প্রত্যেক নারী শিশু অবস্থা থেকে প্রৌড় পর্যন্ত বয়ে বেড়ান। নিজের বাড়ী থেকে শুরু করে স্কুল/লিফ্ট/বাজার/ অফিস/থানা - সর্বত্র, এর কোনো নির্দিষ্ট স্থান, সমাজ, দেশ নেই। ভারতবর্ষে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে একজন নারী ধর্ষণের ভয় থেকে মুক্ত। ধর্ষণ সবচেয়ে বিকশিত এক সামাজিক কর্মকান্ড এই দেশে, সারা পৃথিবীতে যার কোনো তুলনা মেলে না! এখানে একক ধর্ষণ হয়, দলবদ্ধ ধর্ষণ হয়, এবং ধর্ষণের পর খুব ঠান্ডা মাথায়, সূচারুভাবে খুন করা হয়। এখানে বাবা ধর্ষণ করে মেয়েকে, শ্বশুর ধর্ষণ করে বৌমাকে, ছাত্র ধর্ষণ করে শিক্ষিকাকে, শিক্ষক ধর্ষণ করে ছাত্রীকে, দেবর ধর্ষণ করে বৌদিকে, পুলিশ ইন্টারোগেশনের নামে ধর্ষণ করে লক আপে ঢুকিয়ে, আর্মি উগ্রপন্থী ধরার নামে ধর্ষণ করে  ভ্যাজিনাতে গুলি করে.....। ভারতবর্ষ আজ ধর্ষকদের চারনভূমি। মেয়েটি স্কুলে/অফিসে/বাজারে/ যাবে - সে আর কিচ্ছুর ভয় পাচ্ছে না, ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের। চাষী বউ মাঠে যাবে, সে আর কিচ্ছুর ভয় পাচ্ছে না, পাচ্ছে ধর্ষণের। আশাকর্মী মেয়েটি রাতে গর্ভবতী রোগীনির বাড়ি যাবে, সে আর কিচ্ছুর ভয় পাচ্ছে না, ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের। সুজান গ্রিফিন বলেছিলেন " আমি কখনোই ধর্ষণের ভয় থেকে মুক্ত থাকতে পারিনি।" আজকের ভারতবর্ষের প্রতিটা মেয়ে সুজান গ্রিফিন। 

ভারতীয় সমাজে নারী ধর্ষিত হয়েও দোষী। তার মাথা থেকে পা অব্দি প্রত্যেকটা অঙ্গের, তার পরিধান করা পোশাকের, তার চরিত্রের চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ। সে কেন ছোটো জামা পরেছে, সে কেন বুক দেখিয়ে হেঁটেছে, সে কেন এত রাতে বাইরে বেরিয়েছে, সে কেন ছেলে বন্ধুর সাথে বেড়াতে গেছে...........!! ভদ্রলোকেরা এবং ভদ্রমহিলারা উসখুস করে উঠবেন। মেয়েটি নিশ্চয় খারাপ। স্বভাব চরিত্র খারাপ। অসতী। খুব অসতী মেয়ে। ধর্ষণ তো হবেই। এখানে বলে রাখা ভালো, পাশ্চাত্য দেশেও ধর্ষণ হয়, ধরা পড়লে শাস্তিও হয়। কিন্তু সেখানে ধর্ষিতাকে কেউ পোষাক নিয়ে প্রশ্ন করে না, তার চরিত্রের চুলচেরা বিশ্লেষন করে না। এবং হ্যাঁ এটাই পাশ্চাত্যের সাথে ভারতবর্ষের তফাত। 

শুধু সমাজ ও তো নয়। আমাদের আইনি ব্যবস্থাও একই রকম। নারী শুধু ধর্ষিত হলেই চলবে না,তার শরীরে থাকতে হবে মারাত্বক আঘাতের চিহ্ন। তার যোনী থাকতে হবে ক্ষতবিক্ষত। আঘাতের চিহ্ন যত গভীর হবে ততো ভালো। বিচার ব্যবস্থা জানতে চাইবে মেয়েটির কাছে, সে কি একটুও সুখ পেয়েছে? তাহলে চলবে না। এখানে মনে করিয়ে দিতে চাই, এই কদিন আগেও একটা মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে কি না তার জন্য হতো "টু-ফিঙ্গার টেস্ট"। মানে ডাক্তারবাবু হাতের দুই আঙ্গুল মেয়েটির যোনীতে প্রবেশ করিয়ে বুঝতে চাইতেন মেয়েটি আদৌ ধর্ষিত হয়েছে কিনা!! অনেক আন্দোলনের পর এই অমানবিক টেস্ট সিস্টেম বাতিল করানো হয়েছে। আদালত কক্ষে বারবার তার কাছে জানতে চাওয়া হবে, তার সঙ্গমের অভিজ্ঞতা আছে কি না! থাকলে সেটা কেমন? সে এর আগে কার কার সাথে সঙ্গম করেছে? সঙ্গমে সে সুখ পায় কি না? উকিলবাবু বারবার জোর দিয়ে জানতে চাইবেন, ধর্ষণ কখন হয়েছে? কিভাবে করেছে? ওড়নাটা কিভাবে খুলেছে? ব্রা টা খুলেছে নাকি ছিঁড়েছে? কতক্ষণ করেছে? মেয়েটি দু-পা চেপে ধরেছিলো নাকি ধরেনি? বিরতিহীন লাগামহীন প্রশ্ন চলতেই থাকে। এবং আদালত কক্ষে মেয়েটি পুণরায় ধর্ষিত হয়। আরেকটা মজার কথা হলো, আমাদের বিচারব্যবস্থা বৈবাহিক ধর্ষণকে স্বীকৃতিই দেয় না! বৈবাহিক ধর্ষণে আমাদের দেশ পৃথিবীর মধ্যে এগিয়ে, কিন্তু সেই বৃহত্তম গণতান্ত্রিক  দেশের আইনেই, শুধু বৈবাহিক ধর্ষণের কোনো নির্দিষ্ট আইন নাই!! 

কদিন আগে কয়েকজন নারী সহকর্মীর সাথে ধর্ষন রোধে পারিবারিক ভূমিকা কি হতে পারে সেটা নিয়ে কথা বলছিলাম। বলছিলাম "প্রতিটা ঘরে ঘরে যদি বাবা-মা'রা নিজের সন্তানদের শেখান পোষাকের সঙ্গে চরিত্রের কোনো সম্পর্ক নেই, মানুষকে পোষাক দিয়ে বিচার না করে বরং তার চিন্তা,মেধা,মনন দিয়ে বিচার করা উচিত। কেউ ছোটো পোষাক পরলেই তার সাথে খারাপ আচরন করার অধিকার কারুর নেই। তাকে যদি শেখানো হয়, কারুর (নারী হোক বা পুরুষ) ইচ্ছের বিরুদ্ধে, মতের বিরুদ্ধে তাকে ছোঁয়া অন্যায়, অপরাধ, প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাদের যদি শেখানো হয় কারো অধিকার নেই কাউকে ধর্ষণ করবার। এবং স্ত্রী বা প্রেমিকার সাথেও যদি তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয়, সেটাও ধর্ষণ।" - তারা শুনে বলেছিলো, তোমার এই কথাগুলো বেশীরভাগ মেয়েরাই বুঝতে চাইবে না! 

এটাই তো আক্ষেপ আমার। সমাজের বেশীরভাগ নারীর মধ্যেই ঘাপটি গেড়ে বসে পুরুষতান্ত্রিকতা। উচ্চশিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত নারীদের মধ্যে আরো বেশী বেশী করে আছে। তারা বুঝতেই চায় না বা পারে না, স্বামীরাও যে ধর্ষণ করতে পারে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিছানায় টেনে নিয়ে যাওয়াও যে ধর্ষণ, সেটা উচ্চশিক্ষিত নারীরাও বুঝতে পারে না। পিরিয়ড চলাকালীনও শুধু স্বামীর ইচ্ছের কাছে নতি স্বীকার করে দাঁতে দাঁত চেপে সঙ্গমে সায় দিয়ে যাওয়াও যে ধর্ষণ, সেটা তারা বুঝে না। ক্ষেত্রবিশেষে বুঝলেও মানতে চায় না। এইবুঝি সুখের সংসারের ঠুনকো দেয়াল ভেঙ্গে পড়লো, সেই ভয়ে! 

অনেক সময় আশ্চর্য হই, আমরা হিন্দু বুঝি, মুসলমান বুঝি, রাজনীতি বুঝি, সায়েন্স বুঝি, শিল্প বুঝি, আইসিস বুঝি, জেহাদী বুঝি, মহাকাশ পৃথিবী গ্রহ নক্ষত্র চাঁদ তারা সূর্য টেকনোলজি, সাহিত্য - সব বুঝি। শুধু বুঝি না নারীর পূর্ণাঙ্গ মানুষের অধিকার!! জ্বীন, ভূত, ভগবান, আল্লা, ঠাকুর, জেসাস, গুরু, সন্ন্যাসী, পীর - সবেতে বিশ্বাস করি আমরা। শুধু বিশ্বাস করি না নারীও মানুষ এবং মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীতে তার সমঅধিকার! নারীর মানুষ হিসেবে প্রাপ্য অধিকার/সম্মানের ক্ষেত্রে আমরা চূড়ান্ত নীরবতা পালন করে চলি!! 

-"হে ভারত, ভুলিও না তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দয়মন্তী"- আর আমিও বলতে চাই এই আদর্শের ষোলো আনাই হলো নারীকে নির্বোধ, মূক পশু করে রাখার আদর্শ। তাই এটা ভুললে চলবে না। কারন এই কথাটা ভুলে গেলে নারীর পরাধীনতার দীর্ঘ ইতিহাসকে ভুলে থাকা হবে!!

বৃহস্পতিবার, ১০ মে, ২০১৮


এক বিপদজনক প্রেমের থিওরী..
___________________________

এরকম এক অস্থির ঘটনাবহুল সময়ে দাঁড়িয়ে প্রেম নিয়ে লিখতে গিয়ে এক অদ্ভুত রকমের অপরাধবোধে ভুগছি। কিন্তু যেহেতু সকাল থেকে নীল সাদা আকাশ ঢেকে আছে কালো মেঘে; কখনো ঝিরিঝিরি ছন্দে আবার কখনো অঝোর ধারায় নামছে বৃষ্টি। আর বাইরে বৃষ্টি মানে তো বুকের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ে তা। আর বুক মানে তো একটা ছোট্ট গীটার - যেখানে বৃষ্টির ফোঁটা পড়লেই টুংটাং শব্দ বেজে ওঠে। তাই এই অস্থির হলুদ সময়ে অনেকগুলো দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে সেই নিষিদ্ধ ইশারা কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারছি না। মাথা বলছে, "ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য" আর ওদিকে মন বলছে "হারাই হারাই সদা ভয় হয়,হারাইয়া ফেলি চকিতে"। এই টানাপোড়েনে মনের জয় নিশ্চিত, কারন আমি নিজেকে চিনি।

প্রেম, পৃথিবীর সবচাইতেবিশুদ্ধ আবেগ আমার কাছে। বিশুদ্ধতম অনুভূতি। বিশ্বসংসার তুচ্ছ হয় যে প্রেমের কাছে, তার চেয়ে সুন্দর, তার চেয়ে নিষ্পাপ আমার কাছে আর কিচ্ছু নেই।

কবিতা ছাড়া প্রেমকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করতে আমি পারিনা। এবং মুহুর্তেই হেলাল হাফিজের তিনটে লাইন ঘুরঘুর করে মাথায় এল -

"কবিতা তো কেঁদে উঠে যে কোনো অসুখে
নষ্ট সময় এলে উঠোনে দাঁড়িয়ে বলে
পথিক এ পথে নয় ভালোবাসা ঐ পথে গেছে।"

আমার কাছে প্রেম একটা টান। একটা মায়া। যদি কারো জন্যে বুকের ভেতরে টান বোধ করি, বুঝতে পারি সেটা প্রেম। প্রেমই।  সেদিন এক বন্ধুর সাথে ফোনে কথা হচ্ছিল। কথায় কথায় সে বললো "কি সবসময় কাজ আর গম্ভীর গম্ভীর কথা বলিস! তুমুলভাবে একটা প্রেম কর তো এইবারে!" শুনে খুব হেঁসেছিলাম। তাকে বলা হয়নি, আমি তুমুলভাবে প্রেমেই বাঁচি। যে বন্ধু রাতজেগে ফোনে শুধু আমার নতুন লেখার থীম আর গল্প শুনে যায়, এবং ভোররাতে হাই তুলতে তুলতে বলে, "এই শোন, ঘুমোতে গেলাম, বাই!" তার সাথে এই প্রেম ই তো বেঁধে রেখেছে আমায়। যে বন্ধুর সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকে শুধু খিল্লী মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় খয়েরী সময়গুলো অথবা কাকভেজা হয়ে গাড়ীর পিছনের সিটে বসে উল্টোদিকের মহিলার ঘুমের মধ্যে পান চিবুনোর দৃশ্য দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়া যায় - সেখানেও তো সেই প্রেমেরই যাপন।

যে বন্ধু রাত তিনটের সময় তার নতুন লেখা গান শুনায় আমার কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিয়ে, অথবা যে বন্ধু আমার প্রচন্ড ব্যস্ততার মাঝে হঠাৎ ফোন করে জিজ্ঞেস করে "কি রে, শরীর ঠিক আছে তোর?" অথবা প্রচন্ড রাগ দেখিয়ে বলে "এভাবে চললে আর বেশীদিন জীবিত নেই তুই, মিলিয়ে নিস! আরে বাবা শরীরটাতো আগে!" আর আমি তা হাসিমুখে উড়িয়ে দিলেও মনে মনে তার প্রতি যে টান অনুভব করি- সেই টানই আমার বেঁচে থাকার রসদ।

যে বন্ধুর সাথে নারীবাদ কিংবা বিজেপি নিয়ে তুমুল ঝগড়া করে দুদিন কথা বন্ধ রাখি, আর তিননম্বরদিনে নিজেই ফোন করে কপট রাগ দেখিয়ে বলি, "বলি ব্যাপারটা কি! দুদিন ফোন করলি না যে বড়!?" এবং তারপর উত্তরের তোয়াক্কা না করে এভেঞ্জার কিংবা ব্রাদার ইন আর্মসের গল্পে চলে যেতে পারি - সেই নিরীহ নিপাট সম্পর্কই আমার কাছে প্রেম।

কখনো দেখিনি, হয়তো লোকটি নেই ই, শুনেছি বা পড়েছি কোথাও - তার জন্যেও কম টান, কম মায়া বোধ করিনি। এমন অনেক ঘটেছে আমার জীবনে। কালবেলা পড়ে অনিমেষের জন্যে খুব মনকেমন করতো। অপুর জন্যে হু হু করে উঠতো মন। গতবছর "Logan" সিনেমায় যখন হিউ জ্যাকম্যান মানে ওলভারাইন মারা গেলো, দু-রাত ঘুমোতে পারিনি। এই যে, কে যেন নেই,কী যেন নেই। খালি খালি লাগে। এই অনুভূতিটুকুই তো প্রেম। প্রেম আসলেই এক শূণ্যতা এবং হাহাকারের অনুভূতি। প্রাপ্তিযোগে সেটা আর প্রেম থাকে না। অঞ্জন দত্তের কথায় -

"হঠাৎ চায়ের সুগন্ধে
হঠাৎ কোনো বইয়ের পাতায়
হঠাৎ মনের আনন্দে
আপন মনে কবিতায়
হঠাৎ খুঁজে পাওয়া সুর
চার দেয়ালে বেঁধোনা
ধরে রেখোনা!"

হয়তো সুন্দর জোৎস্না রাত, অথবা শীতের নিশুতিঘন রাতে কুয়াশার চাদর  ভেদ করে আবছা কীর্তনের সুর অসম্ভব মনখারাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে আমার সারা ঘরে, আর মনের ভিতর আছড়ে পড়ছে এক একটা হ্যারিকেন - সে মনখারাপটুকুই আমার কাছে প্রেম।

মানুষ প্রেমের পরিণতি ভাবে বিয়ে। আমার বড় অদ্ভুত লাগে! বিয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক কি? প্রেম কি আইন, সমাজ,ধর্ম মেনে হয়? আর বিয়ে হলেই   যে প্রেমের বসবাস থাকবে, এমনটাতো অনিশ্চিত! আসলে প্রেম একটা অবস্থা। এবং অবস্থা কখনো স্থির বা নিদির্ষ্ট হয় না। বরং পরিবর্তনশীল। হয়তো যত্নে বা অযত্নে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, তাই বলে প্রেমকে নিদির্ষ্ট ভাবা ডাহা বোকামী। আবার ও অঞ্জন দত্তের গানে ফিরে আসতে হয় -

"আকাশ হয়ে যাবে ফ্যাকাশে
তবু আমাদের ঘুড়ি
উড়বে মনের আকাশে
অনন্ত ছেলেমানুষি
সেই ছেলেমানুষিটাকে
অন্য নামে ডেকো না
পিছু ডেকো না!"

এই শিমুল তুলোর মতো নিরুদ্দেশ হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে মানুষ কোথায় কার সাথে কখন জড়াবে, তা কি সে নিজেও জানে? সম্ভব কি জানা? একজীবনেই বারবার আসে প্রেম। আসেই। আর প্রতিটা প্রেমই তার নিজের মতো করে আসে, নিজের মতো করে ছাপ রেখে যায়।

আমার প্রতিটি সম্পর্কই প্রেম। হোক সে বইয়ের কোনো চরিত্র, হোক সে রাস্তায় দেখা কোনো অজানা, অচেনা কেউ, অথবা আমার খুব কাছের বন্ধু। প্রেম আছে, আমি আছি। প্রেম নেই আমি নেই, কিচ্ছু নেই। কোথাও নেই।

"তবুও আমার জন্মকবজ, ভালোবাসাকে ভালোবেসেছি
আমার কোনো ভয় হয় না,
আমার ভালোবাসার কোনো জন্ম হয় না, মৃত্যু হয় না।

#সুমনা চৌধুরী
11-05-2018